কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে অসতর্কতায় লাশ হচ্ছেন পর্যটক

সায়ীদ আলমগীর ◑

চলছে পর্যটন মৌসুম। প্রতিদিনই কক্সবাজার বেড়াতে আসছেন অগণিত পর্যটক। সৈকতের বালিয়াড়িতে এসে সাগরজলের সান্নিধ্য নিতে উন্মুখ হচ্ছেন সববয়সিরাই। কিন্তু সাগরের আচরণ না বুঝে বা সাগর সম্পর্কিত নির্দেশনা না মেনে ঢেউয়ের ছোঁয়া নিতে গিয়ে অথই জলে হারিয়ে লাশ হচ্ছে অনেকে। এতে বিষাদে পরিণত হচ্ছে আনন্দ ভ্রমণ। তাই লাইফগার্ড, বিচকর্মীর নজরদারি করা পয়েন্ট ছাড়া অন্যস্থানে সাগরে না নামতে নির্দেশনা দেয় বিচ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, সাগরের আচরণ সবসময় পালটায়। জোয়ারের সময় যেস্থানে সমতল, ভাটার সময় সেখানে খাদের সৃষ্টি হতে পারে। ঘূর্ণিপাকে হঠাত্ সৃষ্টি হয় চোরাবালির। তাই সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্ট যেখানে লাইফগার্ড ও বিচকর্মী দায়িত্বপালন করে সেখানে ছাড়া, সিগাল, ডায়াবেটিস হাসপাতাল পয়েন্টে গোসলে নামা অনিরাপদ। একইভাবে হিমছড়ি, ইনানী, পেঁচারদ্বীপ, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন সাগরে গোসল করতেও সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। এসব স্থানে নজরদারি রেখে উদ্ধারকর্মী দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবল প্রশাসনের নেই।

তাই সৈকত জুড়ে লাল নিশানা উড়ানো স্থানে সাগরে নামা উচিত নয়। তার কথার সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার-বাংলাদেশ (আইডিআরসি-বি)’র সি-সেইফ প্রজেক্ট ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, পর্যটকদের সতর্ক করতেই লাল নিশানা উড়ানো হয়। ভাটার সময় সাগরে নামা নিষেধ। কিন্তু অনেকে এসব নির্দেশনা না মেনে যখন-তখন যেখান-সেখান দিয়ে সাগরে নেমে যায়। এভাবে অসতর্কতায় গত ২০১৯ সালেই সাগরের পানিতে ডুবে মারা গেছেন ৯ জন। এসময় বিপদাপন্নভাবে ৫৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ১১ জনকে প্রাথমিক চিকিত্সা দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে মারা যান ১৩ পর্যটক। সে হিসেবে মৃতের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ২০১৪ সাল হতে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে উদ্ধার হওয়া ২৭৬ বিপদাপন্নের মধ্যে ৫৮ জনকে প্রাথমিক চিকিত্সা দিতে হয়েছে। আর গত এক দশকে এভাবে গোসল করার সময় ভেসে গিয়ে প্রাণ হারান শতাধিক পর্যটক। এদের বেশিরভাগ সাগরের পানিতে নামার নির্দেশনা না মেনে বা গুপ্তখালে পড়ে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

সূত্র মতে, গত ২৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারে বেড়াতে এসে পেঁচারদ্বীপ সৈকতে গোসলে নেমে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারান খুলনা সোনাডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা সাব্বির আহমদের ছেলে স্কুল শিক্ষার্থী রেদওয়ান আহমেদ দেলোয়ার (১৪)। নিখোঁজের একদিন পর তার মরদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজারের ট্যুরিস্ট পুলিশ। আনন্দকে বিষাদে রূপদিয়ে চোখের জলে কক্সবাজার ত্যাগ করেন নিহত দেলোয়ারের পরিবার। শুধু দেলোয়ারের পরিবার নয়, এভাবেই সাগরে গোসল করতে নেমে স্বজন হারিয়ে বুকচাপড়ান অনেকে। শুধু দূরের পর্যটক নয়, স্থানীয় অনেকেও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভেসে গিয়ে লাশ হয়েছে অহরহ। এদের অনেকে ছেলেবেলা থেকেই নোনা জলে সাঁতরিয়ে বড়ো হয়েছেন।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য সাগরে সতর্কতামূলক বিভিন্ন নির্দেশনা থাকে। সচেতনতার জন্য এসব নির্দেশনা মাইকে এবং বিভিন্নভাবে প্রচার করা হয় নিয়মিত। কিন্তু, অনেকেই এসব মানেন না। না মানাদের বেশিরভাগ পর্যটক সাগরে গোসল করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল কর্মকর্তা সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোয়াইট অর্কিড হোটেলের জিএম রিয়াদ ইফতেখার বলেন, পুরো সৈকত জুড়ে পানির নিচে সাগরের বালি নরম থাকে। ঢেউয়ের পানি উপরের দিকে ঠেললেও পানি নিচে নামার সময় সাগরের দিকে স্রোতের টান বেশি। এ টান সামলাতে না পেরে অনেক পর্যটক ভেসে যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে সাগরে একেক সময় একেক পয়েন্টে গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়। গুপ্তখালে আটকে বা সাগরের অথই পানিতে ভেসে গিয়ে অনেকে মারা যান।

তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশুর মতে, সৈকতে গোসলে গিয়ে মৃত্যুর হার কমাতে প্রশাসনের পাশাপাশি হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টদেরও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। প্রতিটি হোটেল-মোটেলে লিফলেট তৈরিসহ সরাসরি সাগরে নামার বিষয়ে সতর্ক করতে হবে বুকিং সময়ে। এছাড়াও সী-নেটিং ব্যবস্থা চালু করা গেলে এ সমস্যা অনেকাংশে কমতো।

কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসার বলেন, পর্যটক সেবায় জেলা প্রশাসন থেকে ৪০ জন বিচকর্মী ও ৩০ জন লাইফগার্ড সদস্য কাজ করছে। সুগন্ধা, লাবণীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে খোলা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র (হেল্প ডেস্ক)। বেড়াতে আসা পর্যটকদের সচেতনতায় সৈকত জুড়ে মাইকিংসহ প্রচারণা নিয়মিত চালানো হয়। ফলে সৈকতে ডুবে প্রাণহানির সংখ্যা কমে এসেছে। সী-নেটিং ব্যবস্থা অনেক ব্যয়বহুল। এরপরও পিপিপি বা অন্য কোনো উপায়ে তা করা যায় কি-না সে পরিকল্পনায় এগুচ্ছে সরকার।